মাহমুদাবাদের নীলকুঠি চিমনি
আকাশে কালো মেঘ থেমে থেমে বৃষ্টি পরছে কোথাও কেউ নেই।ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নীলকুঠি বাস স্ট্যান্ডের উত্তর দিকে আম-জাম-কাঁঠাল গাছ ঘেঁরা নীরব একটি গ্রামের কাঁচা সরু পথ ধরে ৩’শ গজ ভেতরের প্রবেশ করতে দেখা মিলল ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজদের নির্মিত ২’শ বছরের পুরনো নীলকুঠি চিমনি।গ্রামের নাম মাহমুদাবাদ অবস্থিত নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায়।উপস্থিতি দেখে এগিয়ে আসলে একজন বৃদ্ধ।নাম জয়নাল আবেদিন মিস্ত্রি।বয়স আশির ওপরে।চিমনির কথা বলতেই জানালেন এ অঞ্চলে ইংরেজরা তাদের কুঠি স্থাপন করে নীলের আবাদ করত।এই অঞ্চলের মাটি নীল চাষে জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিলো।উপজেলার বটতলী, মির্জানগর, হাইরমারা, চরসুবুদ্ধি, আগারনগর, মির্জাপুরের ও মাহমুদাবাদ ও পূর্বের দিকের দৌলতকান্দি রেল লাইন পর্যন্ত নীলচাষ বিস্তৃত ছিলো।পরবর্তীতে নীলকুঠির নামানুসারে এখানে একটি বাস স্ট্যান্ড ও বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।স্থানটি নরসিংদী জেলা সদর থেকে ৩৮ কিঃ মিঃ ও রাজধানীর সাথে দূরত্ব ৮১ কিঃ মিঃ।
মনোহর মিস্ত্রি
জয়নাল আবেদিন মিস্ত্রি জানান,তার পূর্ব পুরুষদের আদিভূমি ছিলো যশোরে।এককালে এখানে কোন জন বসতি ছিলো না।জন মানবহীন জায়গাটিতে তিন ইংরেজ বেনিয়া জিপিওয়াইজ, ডব্লিউ ওয়াটস্ ও জর্জ লেমন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে জাহাজ ভিড়িয়ে এখানে কুঠি স্থাপন করেন।সবুজ নীল গাছের পাতা থেকে নীল উৎপাদনের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিলো দক্ষ শ্রমিক যা এ অঞ্চলে ছিলো না।ইংরেজরা যশোর জেলা থেকে একজন দক্ষ মিস্ত্রি নিয়ে আসেন।তার নাম ছিলো মনোহর মিস্ত্রি।তার হাত ধরেই এ অঞ্চলে নীল উৎপাদন শুরু।পরবর্তীতে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।সেই মনোহর মিস্ত্রি থেকেই মিস্ত্রি বাড়ির গোড়াপত্তন।
যে ভাবে নীল তৈরী হতো
প্রাপ্ত বয়স্ক নীল গাছের পাতার অংশ বিশেষ কেটে বড় আকৃতির পাত্রে তা ভিজিয়ে রাখা হয়।সেই পানি অন্য আরেকটি পাত্রে রেখে গুটে ফেনা তুলার পর।নীলের প্রকৃত কালার এসে গেলে।ওপরের ফেনাগুলো ছেঁকে ফেলে দিয়ে।তারপর চুল্লির আগুনে গরম করে।ছেঁকে পাত্রে রেখে দিলে নিচে জমা হতো নীল।এবং চিমনি দিয়ে নির্গত হতো চুল্লির সাদা ধোঁয়া।
চাষিদের বাধ্য করা হয়
“বাড়া ভাতে ছাই তব বাড়া ভাতে ছাই
ধরেছে নীলের যমে আর রক্ষা নাই”
কৃষকরা নীল করদের থেকে দাদনের টাকা নেওয়ার সময় টিপসই ও শর্ত সাপেক্ষ চুক্তি অনুযায়ী নীল চাষে বাধ্য করত।অনেক কৃষক নীলচাষ ছেড়ে বাড়ি-ঘর রেখে অন্যত্র পালিয়ে যায়।নীলকররা ক্ষুব্ধ হয়ে কৃষকের ঘরে অগ্নি সংযোগ ও বাড়ি দখল করে নীলের আবাদ করেন।
নীল বিদ্রোহ
এ অঞ্চলের সচেতন কৃষকরা গোপনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নীলবিদ্রোহ শুরু করে।বিদ্রোহী কৃষকদের কে ইংরেজদের লাঠিয়াল বাড়ি থেকে লাঠিপেটা করতে করতে কুঠিতে নিয়ে আসত।চলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা।তাদের শর্ত না মানলে হাত,পা বেঁেধ জ্বলন্ত চুল্লিতে পুড়িয়ে মারা হতো।বাড়িতে অগ্নিসংযোগ,নারী ধর্ষণ ছিলো তাদের নিত্যদিনের ঘটনা।আর এতে সহযোগিতা করত এ দেশীয় মোড়ল-মাতবর।
কুঠির চিমনি
ব্রক্ষপুত্র নদের তীরবর্তী চিমনিটি নীলচাষের ইতিহাস বহন করে আজও টিকে আছে।এ অঞ্চলে কোন এক সময় শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পন আঘাত হানে তাতে এর খানিকটা দেবে গিয়েছিলো।বর্তমানে চিমনির উচ্চতা ৭৫ ফুট।দুটি ধাপে নির্মিত চিমনির পুরো অংশ ইটের তৈরী।প্রথম ধাপ এর উচ্চতা ১৫ ফিট,দৈর্ঘ্য -প্রন্থ ১০ ফুট,দেওয়ালের পুরুত্ব ২.৫ ফুট।দ্বিতীয় ধাপের উচ্চতা ৬০ ফুট, ,দৈর্ঘ্য-প্রন্থ ৯ ফুট,দেওয়ালের পুরুত্ব ২ ফুট।এর ভেতরে ফাঁকা অংশ দিয়ে চুল্লির ধোঁয়া বের হতো।
কুঠির চিমনি
ব্রক্ষপুত্র নদের তীরবর্তী চিমনিটি নীলচাষের ইতিহাস বহন করে আজও টিকে আছে।এ অঞ্চলে কোন এক সময় শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পন আঘাত হানে তাতে এর খানিকটা দেবে গিয়েছিলো।বর্তমানে চিমনির উচ্চতা ৭৫ ফুট।দুটি ধাপে নির্মিত চিমনির পুরো অংশ ইটের তৈরী।প্রথম ধাপ এর উচ্চতা ১৫ ফিট,দৈর্ঘ্য -প্রন্থ ১০ ফুট,দেওয়ালের পুরুত্ব ২.৫ ফুট।দ্বিতীয় ধাপের উচ্চতা ৬০ ফুট, ,দৈর্ঘ্য-প্রন্থ ৯ ফুট,দেওয়ালের পুরুত্ব ২ ফুট।এর ভেতরে ফাঁকা অংশ দিয়ে চুল্লির ধোঁয়া বের হতো।
পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়
পচাঁত্তর ফুট উচ্চতার চিমনির দেওয়া জুড়ে অনেক গুলো ছোট আকৃতির গর্ত রয়েছে।এই গর্ত গুলোতে বাসা বেঁধেছে দেশি প্রজাতির এক শর বেশি টিয়াপাখি।এই পাখি কলরব শব্দে যে কারো মন নিমিশেই ভালো হয়ে যাবে।
চিমনি রক্ষায় আকুতি
কুঠির দক্ষিণ দিকে পুরনো দালানে বাস করেন আবুল কালাম মিস্ত্রি।তিনি জানান এই কুঠিতে তার পূর্ব পুরুষরা কাজ করতেন।অযত্মে অবহেলায় চিমনির সৌন্দর্য্য বিলিন হয়ে যাচ্ছে।আকুতি জানালে সরকারি ভাবে যেন নীলকুঠি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।চিমনি রক্ষায় প্রয়োজনে এর পাশের কিছু জমিও ছেড়ে দিতে তিনি রাজি আছেন।
লেখক - মো. আব্দুল কাদির
লেখক - মো. আব্দুল কাদির
কোন মন্তব্য নেই