শৈশবের গল্প শিকল
গল্প শিকল - আব্দুল্লাহ্ আল মুহাম্মদ আব্দুল কাদের
শৈশবের কাহিনী নিয়ে লেখা ছোট গল্প শিকল
প্রথম পরিচ্ছেদ
বর্ষা আসার আর মাত্র দ্বি-মাস বাকি,বহু পুরানো কড়ইপুর গ্রামের অর্ন্তগত বালুয়াকান্দি বাজার অন্তিক পুলটি পুনঃনির্মাণের জন্য ভেঙ্গে ফেলা হলো।অনেক গুলো শ্রমিক দিয়ে পুলটি ভাঙা হচ্ছে প্রতিটি আঘাতে আমার ভেতরটা যেন বিস্ফুরিত হচ্ছিল,পুলটির দুই পাশে লোক জন তা তাকিয়ে দেখছে এ যেন এক মহা-উৎসব চলছে।উৎসবের উপভোগ থেকে কেউ বাদ যাইনি বুড়া থেকে শুরু করে শিশু বাচ্চা সহকারে এই উৎসবে অংশগ্রহন করতে ভীড় জমিয়েছে রাস্তার দ্বি-ধারে।এ এক আজব দেশ কেউ নাকি বুঝের হয়ে এই রকম পুল ভাঙা দেখেনি।এই পুলটি পার্শ্ববতী তিনটি গ্রামের সাথে বাজারটির সেতু-বন্ধন ঘটিয়েছে।একজন ঠিকাদার উপগত লোকজনের উদ্দেশ্য ঘোষনা করলেন ভাঙা পুলটির কংক্রিট যে যার ইচ্ছে মত নিতে পারবে।আমি একটি সোনালু গাছের ডালে বসে দেখতে লাগলাম লোক জনের কান্ড-কাহিনী,বর্ষা শেষে ধারের পাড়ে মাছ ধরার যে একটি উৎসব হয় সে রকম একটি উৎসব,ঘোষনার সাথে সাখে মানুষ জন কংক্রিট গুলো নেওয়ার জন্য নেমে গেলো।ঘন্টা দুয়েক এর মধ্যে স্থানটি সর্ম্পূণ খালি হয়ে গেলো।তবে বুদ্ধিমান ঠিকাদারে উদ্দেশ্য ছিলো কংক্রিট গুলো বিনা খরচে অপসারণ করা।আমি ভাবছি অন্য কথা ভীষণ চিন্তায় পরে গেলাম রীতি মত পুলটির উত্তর কোনে যুগল সোনালু গাছ ছিলো সূর্যলোকে দূর থেকে সোনালু ফুলের পাপড়ি রৌদ্রের শ্বেতাভে সোনালী আলো ছড়াত।আর চৈত্রের প্রখর গরমে আমি আর আমার মামাত ভাই সোনালু গাছের নিচে বসে কত যে খেলা করেছি তার হিসাব নেই।তার পর দিন বড় খালা মণিদের বাড়িতে মামার সাথে বেড়াতে যায়টা ছিলো অপ্রত্যাশিত।তিন দিন পরে এসে দেখি গাছ দুটি আর নেই,নীরবে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি হত দরিদ্র দিনে আনে দিনে খাই।প্রত্যেকটি বাড়ি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কৃষির উপর নির্ভশীল।বর্ষা এলে গ্রামের সবাই বেকার গ্রায়,বাড়ির মেয়েরা দল-বেঁধে এক বাড়ির কাথাঁ সেলাই শেষ করে অন্য বাড়িতে কাঁথা সেলাই করতে ব্যস্ত রঙবের রঙের নকশী আকেঁ এক একটা কাথাঁয়।আর বাড়ির পুরুষেরা ব্যস্ত মাছ ধরার পুরানো জাল সারানোর কাজে ব্যস্ত।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমাদের দাদা বাড়িটা মেঘনার তীর ঘেঁষে ছোট গাঁ।এই গ্রামটি গোড়া-পতন ঘটে পার্শ্ববর্তী গ্রাম ফকিরেরচর থেকে।হেঁটে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে শেষ প্রান্তে যেতে মিনিট তিন-এক লাগে (মিনি ভিলেজ) যাকে বলে।গ্রামের ৮টা(আট)পরিবার একটি গোষ্ঠীর।আমরা এক ভাই- বোন ছিলাম।গ্রামের সীমান্ত পিরিয়ে আমাদের খেলার আসর অন্য গাঁয়ে আঁচরে পরত।দাদা বড্ড রিক্তক বোধ করতেন হৈ-চৈ।অনেকটা ব্রিটিশদের মত তারা যেমন ভারত বর্ষে তাদের বাণিজ্যিক কুটির স্থাপন করেছিল তেমনি আমাদের খেলার কুটির ছিলো পাশের গ্রামে।বাবা হঠাৎ ঢাকার চাকরি ছেড়ে বাড়তি উপার্জনের জন্য প্রবাসে পাড়ি জমালেন।প্রবাসে গিয়ে তিনি আরো
উল্টো বিপদে পরলেন।এই দিকে বাড়িতে আমরা অর্থ সংকটে,রাতে ঘরে প্রদীব নেই চাঁদের আলোতে রাতের আহার সেরে ঘুমিয়ে পরি,আমাদের ঘরের বাশেঁর ভেড়ার ফাঁক দিয়ে অকৃপন চাঁদ বিনা পয়সায় জ্যোৎস্না বিলায়ত।এই ভাবে অনেক দিন কেটে গেলো।তারপর মা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের কে নিয়ে নানা বাড়ি চলে যাবেন।দাদা বাড়িতে থাকলে আমাদের কে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারবেন না।চারিদিক নদীবেষ্টিত আমাদের গ্রাম গুলো,এখানে সংস্কৃতির চর্চা বলতে আছে অনেক অপসংস্কৃতি ও কুসংষ্কার।পৃথীবি থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপথ।পরদিন একটা ঢিঙ্গী নৌকা করে নানা বাড়ি উদ্দেশ্য রওনা হলাম।আগের বার নানা বাড়ি যাবার বেলায় মা ও আপু মুখে সেই উল্লাস ও প্রাণ চঞ্চলতা নেই।চারিদিকে নীরবতা নদীতে মৃদু হাওয়া বয়ছে।সূর্য্যের আলোতে নদীর পানি গুলো চিক-চিক করেছে কিন্তু আজ পুটিঁ মাছের লাফালাফি চোঁখে পরছে না।
তৃতীয় অধ্যায়
বর্ষার পানিতে পরম আনন্দে স্নানরত গাছ থেকে ঝরে পড়া কদম ফুল গুলো জলে ভাসছে।পাশের লেবু বাগান থেকে ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরছে চারপাশে।পাড়ার ছেলেরা এক সাথে জড়ো হইয়ে খেলা করছে “কানা মাছি বৌ-বৌ যারে পাবি তারে -ছুঁ-এমন সময় মা ডাকছে নাম ধরে,পিছনে ফিরে দেখি মা।আমার এক হাত ধরে বললেন বাড়িতে আয়।তারপর মা বললেন শার্ট টা গা’য়ে দিয়ে নে।আমি জিজ্ঞাস করলাম কেন মা? উত্তরে বললেন তকে আজ মাদ্রাসায় নিয়ে যাবো ভর্তি করাতে, মাদ্রাসায় বড় হুজুরের সাথে তর নানা গতকাল কথা বলে এসেছে।মনটা মলিন হয়ে গেলো কোথায় নানা বাড়িতে সবে মাত্র আসলাম কয়েক দিন খেলাধুলা করবো তার বালাই নাই।আমার মাদ্রাসায় প্রথম দিনের কথা গুলো এখনও বেশ মনে আছে বিকেল বেলা মৃদু হাওয়া বয়ছে চারিদিকে কোরআন এর তেলাওয়াতের ধ্বনি।আমার একটা চিরাচরিত অভ্যাস ছিলো বিকেল বেলায় নিদ্রায় যাওয়া।সেই দিনও তার ব্যতিক্রম হলো না, মাদ্রাসায় বারান্দার সাথের টিনের বেড়াতে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছি আর হাল্কা ঝঁকনি লাগছে সেই ঝাঁকনি থেকে একটা বিটকেল শব্দ হচ্ছিল।হঠাৎ করে পিটের বাম পাশে বড় হুজুর এসে জোড়েসুড়ে একটা বেতাঘাত বসিয়ে দিলো।ব্যথায় আমি অস্থির হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি করেতে শুরু করলাম।তারপর আমার নানা বাড়ির গ্রামের কিছু ছাত্র আমাকে বাড়িতে এসে পৌঁছায়া দিয়ে চলে গেলো।তার পর দিন মনটা ভীষণ খারাপ ভাবতে লাগলা মাদ্রাসায় কি এ রকম ই হয়,সেই খানে বাকি ছাত্র-ছাত্রীরা থাকে কি করে।মা পাশে এসে বসে মাথায় আদুর করে বললো আমার লক্ষী বাবা হুজুরে মারলে কিছু হয় না যে খানে মেরেছে সেই স্থানটা সবার আগে বেহেস্তে চলে যাবে বাবা তকে এই মাদ্রাসায় আর দিবো না,ভালো দেখে অন্য মাদ্রাসায় দিয়ে দিবো।আমি মা’কে বললাম মা হুজুরে যে জায়গাতে মারছে তাহলে ত শুধু সে টুকুই বেহেস্তে যাবে বাকিটার কি হবে!সেই থেকে অবুঝ মনে মা’র বলা কথাটি একটি অগাধ বিশ্বাসের জন্ম নিল।তারপর হুজুরে মার গুলো অমৃত মনে করে পরপারে বেহেস্ত পাবার আশায় নীরবে হজম করে গেছি।
চুতুর্থ পরিচ্ছেদ
মাদ্রাসায় গিয়ে একটি চুপচাপ ও কালো বর্ণের ছেলে সাথে পরিচয়,ছেঁড়া একটা পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে।কিছু ক্ষণ আলাপ-চারিতার পর জানতে পারলাম ছেলেটির নানা বাড়ি কড়ইপুরে নাম ইয়াছিন।পরদিন মাদ্রাসা সাপ্তাহিক বন্ধ।ছুটির দিন মানে অবাধ স্বাধীনতা মামুন ভাইয়ের সাথে কখনও ফানুস ঘুড়ি আবার ডাওক ঘুড়ি উড়িয়ে বিকালটা দিব্যি কেটে যেত,সকালটা কাটত বেশ দুষ্টুমিতে কোন গাছে পাখির বাসা আছে পাখির ছানা আছে কিনা।ফিঙে পাখি মারাত্মক আক্রমনাতক একটি পাখি ফিঙের বাশার আশে-পাশে কাউকে দেখতে পেলেই হলো ধারালো ঠোঁট দিয়ে একে বারে জখম করে ছাড়ত।একদিন আমাকে একা পেয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল।বেচারা ফিঙে পাখির প্রতি আমার প্রচন্ড রাগ হলো আমার বন্ধু বাশার কে বললাম একটা কাজ করতে হবে শুনে ভয় পেয়ে প্রথমে রাজি হলো না যখন বললাম ফিঙের বাসার দুটি ছানার মধ্যে একটি তর আর একটি আমার তখন রাজি হলো।
ফিঙের চোঁখে ফাঁকি দিয়ে ছানা দুটো নিয়ে আসলাম কচ কচে কালো আফ্রিকার নিগ্রোদের মত আমার তেমন পছন্দ হলো না বাশার কে ছানা গুলো বুঝিয়ে দিয়ে আমি লাপাতা।কিছুতে কোন খেলায় মজা পাচ্ছি না।বর্ষাকাল তাই ফড়িং করার কোন উপায় নেই এতে মজা ও ছেলেদের মধ্যে আমার একটা আলাদা গৌরব ছিলো কাপিলা গাছে আঠালো কস পাট কাটির আগাতে লাগিয়ে সকল বালদের থেকে বেশি ফড়িং শিকার করতাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ইয়াছিন ছেলেটা বে-খেয়ালি পড়াশোনায় মনোযোগ বিন্দু মাত্র নেই,নিস্ফলক চোঁখে আকাশ পানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।যেন কোথাও তার ফেলে আসা অতীত গুলো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ওর মা রীতিমত শ্বাসাঘাত করে মাদ্রাসায় রেখে গেছে।এবং মাদ্রাসার হুজুর কে যর্থাযর্থ শাসন করিবার দাঁয়িত্ব ও কর্তব্য পাললে কৃপনতা যেন না করে সেই ব্যাপারে অনুরোধ করে গেছেন।প্রতি বেলা হুজুরের হাতে মার খাওয়া ওর যেন নিয়মে পরিনিত হয়েছে।আজও অনেক মার খেয়েছে।এমনিতেই শারীরিক ভারে রোগা,চোঁখের নিচে জমে থাকা কালো দাগ গুলো দূর থেকে দেখলে মনে হয় “তুর” পাহারের সুরমা।ক্লান্ত দেহে প্রতিদিন মার খেতে খেতে বদহজম হয়েগেছে ওর।মাদ্রাসায় আসার পথে বাজার থেকে নানা’র দেওয়া দুই টাকা থেকে এক টাকা খরচ করে এক পাতা হজমি কিনে ব্যাগে রেখে দিয়ে ছিলাম কখন মনেই ছিলো না।সেই কালের হজমির বর্ণনা আমি দিতে গেলে এখনও হেঁসে মরি,দেখতে বিদ্যুৎ কালো দাঁতের মাজনের মত কুট-কুটে কালো।হাল্কা লবণাক্ত সাথে অনেক টক জিহ্বায় লাগাতেই চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসে।ইয়াছিন কে একটা হজমি দিলাম বললাম নে খা।অতিরিক্ত খেলে জিহ্বা ছিঁলে যাওয়ার ভয়ে আর খাওয়া হলো না যা আছে সারা দিন চলে যাবে।চোঁখ ফেরাতে দেখি খুব মনোযোগ সহকারে হজমি ভোজন করছে,আহা.. রে অনেক দিন মনে হয় এই সব খাইনি বললাম আরো খাবি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।ছুটির ঘন্টা বাজল ব্যাগে স্লেট,চক,আমপাড়া(কায়দা) গুছিয়ে সোজা বাড়িতে।আমার খেলাপড়ার হাতে খুড়ি মা’র কাছ থেকে-নেপোলিয়ানের বিখ্যাত উক্তি “আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও,আমি একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো” আমার মা’র বেলা তার প্রতিফলন নিজ চোঁখে দেখালাম।পর দিন শরীর অসুস্থতার বাহানা দিয়ে মাদ্রাসায় গেলাম না মা ত সবই বুঝে,রেগে কড়া শাসন করলেন আর বললেন তকে মানুষ করার জন্য এত ত্যাগ শিকার করছি আর তুই কিনা এই সব করে পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছিস।আমি ও কম যায়নি রেগে বললাম রাতে অন্ধকারে মাদ্রাসা থেকে আসতে ভয় লাগে,কেরানির বাড়ির পুরানো আম গাছে ভৌত-পেতনি আছে সেই খবর কি তুমি রাখো! এই কথা শুনে নানি বললেন ওরে আর বকাবকি করসি না।নানি বললেন গাছে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক মেরে দিলে গাছে আর ভৌত-পেতনি থাকবে না সেই মত কাজও করলাম আর ভয় ও লাগছে রাতে যদি একা পেয়ে ঘাড় মটকিয়ে দেই।মাথায় একটি বুদ্ধি আটল বাজারে গিয়ে চা’র দোকান থেকে পরিত্যক্ত কন্ডিস মিল্ক এর কোটা সংগ্রহ করতে হবে ।তারপর হবে আমার নতুন আবিষ্কার বাড়িতে কন্ডিস মিল্কের কোঠা এনে উপরের ঢাকনাটা কেটে ফেলে নিচের ঢাকনাটিতে পেরেক দিয়ে বেশ কিছু ছিদ্র করলাম।ছিদ্র করার বিশেষত হলো ভেতরে অক্সিজেন এর প্রবাহটা যাতে ঠিক থেকে আগুন জ্বলতে পারে আর ছিদ্র না থাকলে এর ভেতরে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সসাইড জমে আগুন নিভে যাবে।আর এই ছিদ্র গুলো একই সাথে অক্সিজেন গ্রহন করবে আর কার্বন-ডাই-অক্সসাইড ত্যাগ করবে।এক টাকা দিয়ে চারটি মোমবাতি কিনে সাথে রেখে দিলাম এখন আর রাতে ভৌত-পেতনির ভয় নেই কোঠার ভেতর মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করা যাবে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সাঁকো তে চলাফেরার জন্য বিশেষ ট্রেনিং এর প্রয়োজন ছিলো যা এই অজো পাড়া গাঁয়ে মেলা ভাড়।সাঁকো তে চলাফেরার পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না।পুরাতন পুলটি ভেঙে ফেলাতে তিনটি গ্রামের লোক জনের চলাচলে একটি সংকট সৃষ্টি হয়েছে।তিন গ্রামের বয়জ্যেষ্ঠ ও সচেতন ব্যক্তিরা এই ব্যাপারে একটি জরুরি সভায় বসলেন।এক জনের অভিমত ছোট্ট একটা নৌকার ব্যবস্থা করা যাক,এই প্রস্তাবে কিছু সংখ্যক মানুষ রাজি হলেও অন্যদের মতামত হলো নৌকার জন্য মাঝি লাগবে তাছাড়া সারাক্ষণ মাঝি না ও থাকতে পারে সেই সাথে মানুষের প্রয়োজনে যখন- তখন বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পরতে পারে ।একজন মুরব্বি দাঁড়িয়ে বললেন তাহলে সবার থেকে চাঁদা তুলে বাশঁ কিনে আর স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে একটা সাঁকো বানালে কেমন হয়।সবাই দলমত নির্বিশেষে এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন।সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুঁয়ে মিষ্টি আলু খেতে খেতে বাড়ি থেকে বের হলাম,সাথে ব্যাগে স্লেট,চক,আমপাড়া।গতকাল মাদ্রাসায় যাওয়া হয়নি আজ না গেলে বাড়িতে মা ঢুকতে যে দিবেন না তা নিশ্চিত।মিনিট তিনেক হেঁটে সাঁকোর কাছাকাছি সাঁকোটা দেখেই গা শিহরন দিয়ে উঠল,আড়াআড়ি দুটো করে বাঁশ পুঁতে একটা বাঁশ লম্বালম্বি পেতে একটার সাথে একটা জোড়া লাগিয়ে সাঁকোটি নির্মাণ করা হয়েছে।এই সরু সাঁকো দিয়ে কি ভাবে যাবো,আস্তে আস্তে পা চালাতে লাগলাম মাঝ খানে যাওয়ার পর দু-পা কাঁপছে যা বেড়েই চলছে কিছুতে যেন থামছে না।শেষমেষ আর রক্ষা নেই সাঁকো থেকে বর্ষার পানিতে পরে গেলাম।পাঞ্জাবি-লুঙ্গি ভিজে একাকার।পানিতে প্রচন্ড স্রোত বয়ছে,সাথে থাকা স্লেট তত ক্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে আর আমপাড়াটি স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।প্রাণ পর্ণে পানিতে ঝাঁপ দিলাম যে ভাবে হউক আরবিতে লেখা কায়দাটা উদ্ধার করতেই হবে।আমরা যারা মুসলমান তারা আরবি অক্ষরে লেখা যে কোন কিছুর প্রতি ছিলো অগাধ শ্রদ্ধা কোথাও আরবি তে লেখা কিছু পরে থাকতে দেখলে তা সালাম করে ঘরের বেড়াতে অথবা পানিতে ভাসিয়ে দিতাম যাতে করে কারো পায়ের তলায় না পরে।সেই বেলা মাদ্রাসায় যেতে অনেক সময় বিলম্বিত হলো। মাদ্রাসায় চুপচাপ ঢুকে ইয়াছিন কে লক্ষ্য করে অর পাশে বসে পরলাম।
হুজুর সকল ছাত্রদের উদ্দেশ্য ঢিলা-কলুফের গুরুত্ব সর্ম্পকে কথা বলছেন ঢিলা-কলুফ লওয়া সুন্নত মুসলমানের জন্য।বর্ষা আসার পূর্বে সরিষা ক্ষেত্র থেকে শুকনো ইটা মাটি মাদ্রাসায় প্রয়োজনে ছাত্রদের দিয়ে স-যত্নে মাদ্রাসায় পূর্ব পাশে বাগানের এক পাশে রাখা হয়েছিল।সেই মাটি পানি দিয়ে ঘুলে নরম করে মারবেল এর মত করে বানাতে হবে প্রত্যেকে একশত করে।সকল ছাত্রের বেলায় এটা প্রযোজ্যএই মারবেলর আকৃতির মাটির জিনিসটি নাম ঢিলা।এই কাজে বিশেষ নৈপূর্ণ ও পারর্দশী ছিলো ইয়াছিন।ওর কাজে যেন শিল্পির ছোঁয়া।ছেলেটা মৃতশিল্পে ভালো করতে পারত কিন্তু এই অজো পাড়া গাঁয়ে এর বিশেষ মূল্যে কাহারো নিকট নেই।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
তখনকার ধর্মাঅন্ধা সমাজ ব্যবস্থা এখন কিছুটা পরির্তন হলেও সেই রীতি ও বিশ্বাস মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে তা যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে।আমার মা চেয়েছিল আরবি বিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে বেহেস্তের যাবার দরজা সুগম হবে।কিন্তু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিদ্যা আমার গলায় আটকে গেছে আমার স্বাধীনতা আমাকে অন্য দিকে দাবিত করেছে। মাদ্রাসার হুজুরদের সিমাহীন শাসন ব্যবস্থা তখন অবুঝ মনে একটা ক্ষোভের জন্ম নিয়েছিলো।পরদিন মাদ্রাসায় গিয়ে দেখি ইয়াছিনের পায়ে শিকল,একটি দুই ফুট লম্বা গাছের গুড়ির সাথে শিকল লাগিয়ে,তালা মেরে রেখেছে।হুজুরদের বিশ্বাস ছিলো যত শাসন করা যাবে পড়াশোনায় মনোযোগ বেড়ে যাবে এতে ভয়-ভীতি সম্পন্ন ছেলে-মেয়ে গুলো জোড়ে সোড়ে পড়ত বটে কিন্তু শিখত কতটুকু তার প্রমাণ মেলা ভার।যার মন এই ঘরে থাকতে চাই না তাকে হাজারো চেষ্টা করে ও ধরে রাখা যায় না।আমি রীতিমত হতাশ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম,যে করে হউক এর থেকে মুক্ত করা চাই।পরাধীনতার মধ্যে আটকে গেলো ইয়াছিনের জীবন এই টুকু ছোট্ট বয়সে মা-বাবা ছাড়া অচেনা একটি জায়গায় থাকা তারপর আবার পায়ে শিকল।তখন জীবনে প্রথম বুঝতে শিখেছি স্বাধীনতা ও পরাধীনতা।ইয়াছিন কোথাও গেলে অতি কষ্টে গাছের গুড়ি সাথে বহন করে নিয়ে যেতে হতো।মাঝে মাঝে আমি সাহায্য করতাম যখন ও বাথ রুমে যেত। মাদ্রাসার পূর্ব দিকে রাস্তার পাশের ক্ষেত গুলো বর্ষার পানিতে পরিপূর্ণ এখন মুখ্যম সময় বুদ্ধিটা মন্দ না অতি সহজ।পরদিন ইয়াছিনের সাথে জীবনের শেষ কথোকপন অ বলেছিল বন্ধু মুক্ত হতে পারলে বহুদূর চলে যাবো যে খানে কেউ শাসন করবে না পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না আরো বলেছিলো রাতের অন্ধকারে যখন সবায় ঘুমিয়ে যাবে তখন পানি দিয়ে সাঁতরিয়ে চলে যাবো।সেই রাতে অনেক জ্যোৎস্না ছিলো।রাতের নীরবতায় ইয়াছিন জ্যোৎস্নায় মিশে বহুদূর চলে যায়।সকালে ঘুম থেকে উঠে বাশার’দের বাড়িতে গিয়ে খাঁচায় বন্দি ফিঙে পাখির প্রাপ্ত বয়সষ্ক ছানা গুলোকে মুক্ত করে দিলাম।বাঁধ ভাঙা আনন্দে উড়তে লাগল ডানা মেলে মুক্ত আকাশে।
কোন মন্তব্য নেই